মে মাসজুড়েই চলেছে তাপপ্রবাহ। তার সঙ্গে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যোগ হয়েছে গুমোট আবহাওয়া। এতে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় অসহনীয় গরম অনুভূত হচ্ছে সারাদেশে। এর মধ্যেই সোমবার পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকার গভীর নিম্নচাপটি পশ্চিম-উত্তর পশ্চিম দিকে সরে আরও ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। 

এর প্রভাবে বিকেল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক কাটছে না।বাংলাদেশের উপকূল থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে পাক খেতে থাকা ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ঘণ্টায় চার কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তর-উত্তর পশ্চিমে, ভারতের ওডিশা আর পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে। 

পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে এগিয়ে বুধবার প্রথম প্রহরেই ওডিশার উত্তর উপকূল, পশ্চিমবঙ্গ উপকূল এবং খুলনা এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা। 

সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার। ইয়াস এখন যে পথ ধরে এগোচ্ছে, গতিপথ একই রকম থাকলে বাংলাদেশের ক্ষতির ঝুঁকি কম হবে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।ঘূর্ণিঝড়টি গতিপথ পরিবর্তন না করলে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। তবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় মাঝে মাঝেই গতিপথ পরিবর্তন করে। 

এটি দিক পরিবর্তন করলে বাংলাদেশের উপকূলের দিকেও আসতে পারে। ফলে বাংলাদেশের বিপদের শঙ্কা এখনও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, ২০০৮ সালে মিয়ানমার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় 'নার্গিস'-এর কারণে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। নার্গিস সৃষ্টি হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা ভারতের ওডিশা উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। 

এরপর হঠাৎ সম্পূর্ণরূপে দিক পরিবর্তন করে মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানে। ফলে ইয়াসের বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানার শঙ্কা এখনও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপকূলের প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, বড় বড় যত ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, তার সপ্তাহখানেক আগে তাপমাত্রা অসহনীয় থাকে। এবারও সে রকমই প্রখর তাপ অনুভূত হচ্ছে। 

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানার কথা বুধবার, ওই দিন ভরা পূর্ণিমা। পূর্ণিমার সময় উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়মেই দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ওই দিন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। 

কুয়াকাটার লেম্বুরচরের জেলে ফোরকান হাওলাদার বলেন, 'পূর্ণিমার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আইলে সব ভাসাইয়া লইয়া যাইবে।'বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ইয়াস বর্তমান গতিপথ না বদলালে বাংলাদেশে আঘাত হানবে না। তবে এর প্রভাবে সুন্দরবন এলাকায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হতে পারে।ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় রূপে আগামী বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও ওডিশায় আছড়ে পড়তে পারে। 

এর প্রভাবে আজ মঙ্গলবার থেকেই ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে।আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, এখন ঝড়ের কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬২ কিলোমিটার। এই গতিবেগ দমকা বা ঝড়ো হাওয়া আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছের সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। 

দেশের চার সমুদ্রবন্দরকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেতের পরিবর্তে ২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করবে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন। শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি এ দেশে এলে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলা লণ্ডভণ্ড হবে। 

আর না এলেও এর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়বে এই চার জেলা।আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত বিশেষ সতর্ক বার্তায় বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬৮৫ কিলোমিটার থেকে কিছুটা এগিয়ে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছে। 

কক্সবাজার থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এগিয়েছে। কিন্তু মোংলা ও পায়রা থেকে একই দূরত্বে আছে এখনও। মোংলা বন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। 

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি সতর্কতামূলক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।উপকূলে আতঙ্ক: ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।