করোনাভাইরাসে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। 

লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। তাতেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থামানো যাচ্ছে না। গত বছরের এ সময়ে তুমুল বৃষ্টি হলেও এবার খটখটে রোদ, দাবদাহের দাপট। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা দাবদাহে হাঁসফাঁস অবস্থা। 

করোনার সঙ্গে লড়াই আর রোজার ক্লান্তির মাঝে প্রচণ্ড গরমে দুঃসহ অবস্থায় পড়েছে মানুষ।আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে লঘুচাপ কমেছে বঙ্গোপসাগরে, আর কালবৈশাখীতেও দেখা নেই বৃষ্টির। অদ্ভুত আচরণ করছে আবহাওয়া। 

গত মার্চ মাস থেকে দেশে বৃষ্টি হচ্ছে খুবই কম। এপ্রিলে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি ঝরেছে। তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে ক্রমাগতভাবে। সপ্তাহখানেক ধরে তাপমাত্রা থাকছে ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।গত সোমবার ঢাকায় ছিল ২৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত সাত বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ।আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঢাকায় ১৯৯৫ সালে সর্বশেষ ৩৯ ডিগ্রিতে উঠেছিল তাপমাত্রা। 

ওই বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয় যশোরে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল ১৯৬০ সালে।আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বছর এই তাপমাত্রায়ও সমস্যা হতো না, যদি আবহাওয়ার স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুযায়ী। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হতো। তা না হওয়ায় ভূপৃষ্ঠে পুঞ্জীভূত তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে গরমের অনুভূতি। সকালে সূর্যের আলো ফুটতেই গরম শুরু হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অসহ্য গরম থাকে। সন্ধ্যার পর গুমট হয়ে ওঠে পরিবেশ, রাতেও ভ্যাপসা গরম। 

এমন অবস্থায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দিনের বেলা স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি দরকার ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট হয়ে উঠেছে অসহনীয়।রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুপুর হতেই অলিগলিতেও লোকজনের চলাফেরা একেবারে কম। অনেকে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যান।

শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, গরমের কারণে এমনই 'অস্থির' অবস্থা বিরাজ করছে সারাদেশে। আবহাওয়া পরিস্থিতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি সরবরাহের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। অধিক তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলেরও। দেশের বিভিন্ন স্থানে টিউবওয়েল ও শ্যালো মেশিনে পানি উঠছে না।তবে আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, বৈশাখে বৃষ্টি না থাকায় এমন আবহাওয়া। 

স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী বৈশাখের এই সময়ে ১০ ভাগ বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। বঙ্গোপসাগর থেকে যে আর্দ্রতার জোগান আসার কথা, তাও আসেনি তেমন। স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মে মাসের গরমও হতে পারে এপ্রিলের মতোই তীব্র।ড. মান্নান বলেন, সারা পৃথিবীতেই তাপমাত্রা বাড়ছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। আমাদের বঙ্গোপসাগরের আচরণও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বরং স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে সাগর শান্ত আছে। 

এ কারণে পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাব কম পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে কম পাওয়া যাচ্ছে জলীয়বাষ্পের জোগানও। ফলে এ বছরের আবহাওয়া গত কয়েক বছরের তুলনায় ভিন্নধর্মী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কিছু দীর্ঘমেয়াদি কারণ রয়েছে। যখন এক দেড় ঘণ্টার কালবৈশাখী হয়, তখন অন্তত দেড়শ থেকে দুইশ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এবার কালবৈশাখীতে বৃষ্টি হয়নি। এজন্য তাপমাত্রা কমছে না।এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহ্‌দ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিশ্বে উষ্ণায়নের বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। 

নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছও। প্রকৃতির সঙ্গে যেমন আচরণ করা হবে, প্রকৃতিও ঠিক সেভাবেই ফিরিয়ে দেবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো না গেলে তাপমাত্রা প্রতিবছর তার পূর্ববর্তী বছরের রেকর্ড ভাঙবে।গত ২০ বছরে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে বলে চলতি মাসে 'সার্ফেস আরবান হিট আইসল্যান্ড ইনটেনসিটি ইন ফাইভ মেজর সিটিস অব বাংলাদেশ: প্যাটার্নস, ড্রাইভার্স অ্যান্ড ট্রেন্ডস' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, ভয়াবহ গরমের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। 

এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় 'লা নিনা' নামের এক বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবেই আবহাওয়া দ্রুত এমন দুর্যোগপূর্ণ হচ্ছে। এটা আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। বিষয়টি এখন আর অবহেলা করার মতোও নয়। সরকারকে এখনই জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।দাবদাহে পুড়ছে যশোর। যশোর অফিস জানিয়েছে, অব্যাহত দাবদাহে পুড়ছে ওই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি। টানা তিন দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে। 

ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও প্রায় ৩৯ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে সুপেয় পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে।গত রোববার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। 

গত সোমবার যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।যশোর আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলমান তাপপ্রবাহ সপ্তাহজুড়ে অব্যাহত থাকতে পারে।রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গত দু'দিনে রাজশাহীতে দুই ডিগ্রি তাপমাত্রা কমেছে। 

তবে দাবদাহের অনুভূতি কমেনি। মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন সোমবার ছিল ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার ছিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।