দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর শাসন চলেছে, সেটি হচ্ছে মিয়ানমার।ব্রিটেনের কাছ থেকে এক সময় বার্মা নামে পরিচিত দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে, আর এর পর থেকে মিয়ানমারের গত ৭৩ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন চলেছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে।মিয়ানমার বিষয়ক পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশটির রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর যে বিশাল প্রভাব রয়েছে, সেটি বেশ অভাবনীয়।নিকটতম প্রতিবেশী এই দেশটিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বেশি হওয়ার পেছনে অবশ্য ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে।২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের জন্য অং সান সু চি-র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) একটি বেসামরিক সরকার গঠন করলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে সেই সরকার বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো বেরিয়ে আসতে পারেনি।এশিয়ার আরও অনেক দেশের মতো এটিও ছিল ব্রিটেনের শাসনাধীনে এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়।বার্মার স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন জেনারেল অং সান, যাকে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।ব্রিটেনর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের ছয় মাস আগে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন অং সান। তবে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বার্মার জনগণ সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো, তাদের মনে করা হতো দেশের রক্ষাকারী হিসেবে।অন্যদিকে, স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বার্মায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করে যে দেশটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ভূমিকা রেখেছে। 

নতুবা বার্মা ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হয়ে যেত বলে সেনাবাহিনী দাবি করে।বার্মার সামরিক বাহিনী তাতমডো নামে পরিচিত এবং এর মূল শাখা বাহিনী হলো সেনা, নৌ এবং বিমা্নবাহিনী।স্বাধীনতা লাভের পর বার্মায় একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় উ নু'র নেতৃত্বে।কিন্তু সেই সরকার শুরু থেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। বার্মায় তখন নানা ধরণের অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। জাতিগত সংঘাত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে দেশটি।পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী উ নু সেনাবাহিনীকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।মিয়ানমারের 'উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী' লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিম।জেনারেল নে উইন ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার, আর তার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয় ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত।১৯৬০ সালে বার্মায় একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর উ নু'র নেতৃত্বে আবারও একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু ওই সরকারও চলমান অস্থিরতাগুলো সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।ওই ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেই থেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ৫০ বছর ধরেই চলছে বার্মায় সামরিক শাসন।

সংবিধান ও সেনাবাহিনী

মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সেনাপ্রধান নিজেই নিজের বস। অর্থাৎ তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত লোয়ি ইন্সটিটিউট-এর পূর্ব এশিয়া বিষয়ক গবেষক অ্যারন কনেলি ২০১৭ সালে সিএনএন-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটা বলেছিলেন: "মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে যদি বলা হয়, দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ নাকি আন্তর্জাতিক সম্মান - তোমরা কোনটি চাও? তারা দেশ নিয়ন্ত্রণ করাটাকেই বেছে নেবে।কনেলি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেসামরিক রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা পুরোপুরি ছেড়ে দিতে মোটেও রাজী নয়।সেনাবাহিনী যতটুকু ছাড় দেওয়ার, ঠিক ততটুকুই তারা দিয়েছে ২০০৮ সালে গৃহীত সংবিধানের মাধ্যমে। এর বেশি ছাড় সেনাবাহিনী দেবে না বলে মনে করেন এই গবেষক।২০০৮ সালের ওই সংবিধানে মিয়ানমারের সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।তবে শুধু আসন সংরক্ষিত রাখাই নয়, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। এ তিনটি বিষয় হচ্ছে - স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়।মিয়ানমারে বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে, সেটি বেসামরিক সরকারের উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।

কে এই জেনারেল মিন অং লাইং

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৮ই নভেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার পর যদি অং সান সু চি'র সরকার গঠিত হতো, সেই সরকার কি সংবিধান সংশোধন করতে পারতো? তেমন একটি সম্ভাবনা কি তৈরি হয়েছিল?বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংবাদদাতা জনাথন হেড মনে করেন, সংবিধান সংশোধন করা অং সান সু চি-র পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না।এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে সংবিধান সংশোধন করতে হলে সংসদে ৭৫ শতাংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। যেহেতু সেনাবাহিনী সংসদ সদস্যদের ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী, তাই তাদের সমর্থন ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়।

সেনাবাহিনী ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি

মিয়ানমারের সামরিক শাসন নিয়ে গবেষণা করেছেন জার্মানির গিগা ইন্সটিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক ম্যাক্রো বুন্তা।তিনি লিখেছেন, একটি দেশে বেসামরিক সরকার যখন কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়, তখন সেখানে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে।বার্মা প্রসঙ্গে মি. বুন্তা লিখেছেন, স্বাধীনতা লাভের ছয় বছর আগেই বার্মিজ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বেও ছিল দেশটির সেনাবাহিনী।ফলে বার্মিজ সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকদের মধ্যে রাজনৈতিক মনোভাব শুরু থেকেই ছিল বলে তিনি মনে করেন।বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনীর ভেতরে এমন আশঙ্কা রয়েছে যে রাজনীতি শক্তিশালী হলে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমে যাবে। সেজন্য যারাই সামরিক জান্তার বিরোধিতা করছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে।শক্তিশালী এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করেছিল তৎকালীন সামরিক জান্তা। ওই নির্বাচনে অং সান সু চি-র নেতৃত্বে এনএলডি জয়ী হলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি সামরিক জেনারেলরা।

কিভাবে প্রভাব বজায় রাখছে সেনাবাহিনী?

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই ১৯৬২ সাল থেকে টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত শক্ত হাতে সরাসরি দেশ শাসন করে।দেশটির মোট জাতীয় বাজেটের ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় সামরিক খাতে।ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ২০০১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার্মার সঙ্গে জাপান এবং ভারতের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও ১৯৮৮ সাল থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়।চীন হচ্ছে প্রথম দেশ যারা মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তখন থেকে চীন এবং মিয়ানমারের মধ্যে জোরদার সম্পর্ক তৈরি হয়।এছাড়া আসিয়ান জোটে যোগদানের ফলে বার্মার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। মিয়ানমারে সামরিক শাসন নিয়ে এসব দেশ কখনোই তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশটির বেসরকারি খাতের অর্থনীতিও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।বার্মায় সরাসরি সামরিক শাসন চলার সময় দেশটির উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু তাতে সামরিক জান্তার অস্ত্র সংগ্রহ থেমে থাকেনি। ওই সময় চীন এবং ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে দেশটি।মিয়ানমার বিষয়ক পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশটির সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের মনে এমন ধারণা দিতে চায় যে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী এবং সব ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।