করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্যতার হার গ্রামের তুলনায় বেশি বেড়েছে শহর ও মফস্বলে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এর সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষের সব ধরনের ব্যয় করার ক্ষমতা কমেছে, তবে আয়ের সিংহভাগ খাদ্য কিনতে ব্যয় করার প্রবণতা দেখা গেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে আসা মানুষগুলো নিজে থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় আছে। 

তাছাড়া সার্বিক রেমিট্যান্স আয় বাড়লেও জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো জানিয়েছে, আগের বছরগুলোর তুলনায় গত বছর বিদেশে থাকা স্বজনেরা কম টাকা পাঠিয়েছেন।শনিবার 'বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিট-১৯ মহামারি প্রভাব: সানেমের দেশব্যাপী সমীক্ষার ফলাফল' শীর্ষক ভার্চুয়াল তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। গবেষণা তথ্য তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। 

তিনি জানান, ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সঙ্গে যৌথভাবে দেশের ৬৪ জেলার ১০ হাজার ৫০০ খানার ওপর জরিপ হয়। ওই খানার মধ্যে গত বছর পাঁচ হাজার ৫৭৭টির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে সানেম। এ দুই জরিপের ফল তুলনা করে গবেষণাটি চালানো হয়েছে।জরিপের তথ্য তুলে ধরে সেলিম রায়হান বলেন, গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার বেড়ে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন ও সানেমের জরিপের ফলে এ হার ছিল ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপে সার্বিক দরিদ্রতার হার ছিল ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। বিবিএস এর খানা জরিপে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিলো ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিলো ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে এ হার বেড়ে ৪৫ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। 

শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যতার হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিলো ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।সেলিম রায়হান আরও জানান, গত বছর চরম দারিদ্র্যতার হার বেড়ে সাড়ে ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে জিইডি-সানেমের জরিপে যা ছিল ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যতার হার ২০১৮ সালে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং গত বছর বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ২০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যতার হার ২০১৮ সালে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ।জরিপের তথ্য তুলে ধরে সেলিম রায়হান আরো জানান, ২০১৮ এবং ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় কমেছে। 

অতি দরিদ্র পরিবারের এ হার কমেছে সবচেয়ে বেশি (৫৮ শতাংশ)। অন্যদিকে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে। করোনার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন শিক্ষায় অংশ দিয়ে গ্রামাঞ্চলের ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং শহরাঞ্চলের ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। যারা অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে না পারেননি তারা এর কারণ হিসেবে অনলাইন ক্লাসের অপ্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অপ্রাপ্যতা, ডিভাইসের অপ্রতুলতা, ইন্টারনেট সংযোগের অপর্যাপ্ততা, ইন্টারনেট সংযোগের ব্যয় বহন করতে অক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন।জরিপে ফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মহামারির সময়ে সংকট মোকাবেলার দরিদ্র মানুষেরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। 

এর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন, ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ সঞ্চয়ের ওপর নিভর্র করেছেন, ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছেন, ২৭ দশমিক ২ শতাংশ বাধ্য হয়ে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন এবং ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন।জরিপের চমকপ্রদ তথ্য হলো, করোনাকালিন সময়ে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আয় বাড়লেও পারিবারিক পর্যায়ে অভিবাসী সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ কমেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের দাবি, তারা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স কম পেয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরের মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ দাবি করেন, তারা মহামারির আগে যা পাচ্ছিলেন তার তুলনায় কম পেয়েছেন। এ বৈপরিত্যের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল মহামারির আগে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছিল। 

যেহেতু এ চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়েছে, তাই পরিবারগুলো আগের তুলনায় কম অর্থ পেয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এম এম আকাশ বলেন, কোভিডের কারণে যে ক্ষতি হল এটি কি স্বল্পমেয়াদী, না-কি এত বছরের অগ্রগতির ওপরে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ল, তার ব্যাখ্যার বিষয়। 

এটি নির্ভর করবে ক্ষতির ধরণ কেমন, কোন খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকার যে জরুরি পদক্ষেপ নিল তা কতটুকু পর্যাপ্ত তার ওপর। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব চালু করতে হবে, স্বাস্থ্যখাতে ভর্তুকি দিতে হবে, কর্মসংস্থানের পরিবর্তনগুলো স্বীকার করে ব্যবস্থা নিতে হবে।সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ সমীক্ষার মাধ্যমে মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদী পর্যায়ে দারিদ্র্যতার ওপর প্রভাব পড়ছে এবং কোভিড-১৯ এর পূর্বের দারিদ্র্য বিষয়ক অর্জনগুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে উলটে যাবে, সেই ধারণাটি আরও জোরালো হয়েছে। কঠিন সময়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে যারা সচ্ছ্বল তাদের ওপর অত প্রভাব না পড়লেও দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট উপায় নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ অসমতা দূর করতে উদ্যোগ বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। 

কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধির ধারা কোভিডের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়িয়েছে। যে কর্মসংস্থান হারিয়েছি সেটি পুনোরুদ্ধারে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে বেশ কয়েকবছর লেগে যাবে। তার ওপর প্রযুক্তির আগ্রাসনের ফলে বহু কর্মসংস্থান বিলীন হয়ে যাবে এবং অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলার প্রয়োজন ছিল যেন দরিদ্রের হাতে অর্থ যায় এবং সেই অর্থ দিয়ে তারা বাজারে গিয়ে পণ্য কিনতে পারে।অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ জরিপের তথ্য বলছে, দারিদ্র্যের ভৌগোলিক আওতা ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রামেও যে হারে দারিদ্র্যতা বেড়েছে শহরেও সেই একই হারে বেড়েছে। 

আবার যেখানে আগে দারিদ্র্যতা কম ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে, যেখানে বেশি ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে। দারিদ্র্যতার বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা চিকিৎসায় প্রভাব, সে বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। শিক্ষায় দারিদ্র্যতা বেড়েছে, শিক্ষায় ব্যয় কমেছে, বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থায় বেশিরভাগই অংশ নিতে পারছে না।ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ আছেন যারা দারিদ্র্যরেখার ওপরে ছিলেন, কিন্তু কোভিডের আঘাতে দারিদ্র্যরেখার নিচে নেমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ তারা দারিদ্র না হয়েও দারিদ্র্যতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। 

৩২ শতাংশ মানুষ মোকাবেলার জন্য আগের সঞ্চয় ব্যবহার করছেন, আবার অনেকে খাদ্য তালিকায় অনিচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি ও সুস্বাস্থের ওপর আঘাত থেকে যাবে, যদি তারা প্রয়োজনীয় সহায়তা না পান। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়গুলি আরও বেশি মাথায় রাখার তাগিদ দেন তিনি।