আর্থিক সঙ্কটে চীন। দিশেহারা চীনের অর্থনীতি। তাই খরচ কমাতে শুরু করেছে কমিউনিস্ট শাসিত দেশটি। এমনটাই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেজ্ঞরা। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজরে এসেছে চীনের বেহাল আর্থিক অবস্থার বিষয়টি। 

শোনা যাচ্ছে, আর্থিক সঙ্কটে চীন তাদের স্বপ্নের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পেও টাকা ঢালার বিষয়ে বেশ সতর্ক। একাধিক কর্মসূচিও তারা স্থগিত রেখেছে। 

বস্টন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, চীনের দুটি সরকারি সংস্থা চায়না ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ও এক্সপোর্ট-অমোর্ট ব্যাঙ্ক অব চায়নার বিনিয়োগ ঘাটতির বিষয়টি। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ২০১৬ সালে ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল বিআরআই প্রকল্পে। ২০১৯ সালে সেই বিনিয়োগের পরিমাণ করে দাংড়ায় মাত্র ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালে আরও কমে বিনিয়োগ। মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার চীন খরচ করেছিল তাদের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড প্রকল্পে। অবশ্য বিতর্কের গন্ধ পেয়ে নামটডি বদল করতে বাধ্য হয় চীন সরকার। ওয়ান শব্দটির মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছিল চীনের আধিপত্যবাদী মনোভাব। এখন তাই বহুজাতিক সড়ক ও পরিকাঠামোগত প্রকল্পটির নাম বিআরআই করতে বাধ্য হয়েছে চীন। নাম বদলেও অবশ্য লাভ হচ্ছে না। চীনের ছন্নছাড়া অর্থনীতি বিআরআই-কেও বিপথে চালিত করছে বলে অনেকে মনে করছেন। 

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চীন এখন তাদের এই ক্রমসূচি থেকে পিছু হঠছে। বহু কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি)-এরও অন্তর্জলি যাত্রাও নাকি শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে খরচ করার কথা ছিল ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটির এই প্রকল্প থেকেও নাকি চীন পিছু হঠছে। 

অথচ এই প্রকল্পটি চীনের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থলবেষ্টিত চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ এই প্রকল্পের মাধ্যেই আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারত। 

পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরকে ব্যবহার করে চীন সহজেই পণ্য। পরিবহনের নতুন পথ পেতো। সিপিইসি প্রকল্পে মাধ্যমে মাল্লাকা স্ট্রেইটের মতো ব্যস্ত নৌ-পথকে এড়িয়ে সহজেই বহিঃবিশ্বে পণ্য পরিবহনে সুবিধার কথা মাথায় রেখেই চীন এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। 

এছাড়াও জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের ভয় রয়েছে ভারতের ওপরও। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে মাল্লাকা স্টেইট দিয়ে জাহাজ চলাচলে সহজেই বিঘ্ন ঘটাতে পারে পার, এই আশঙ্কা রয়েছে চীনের। কিন্তু তারপরও সিপিইসি প্রকল্প নিয়ে এখন আর হেলদোল দেখাচ্ছেনা বেজিং। 

পাকিস্তানে পরিকাঠামো উন্নয়নে সিপিইসি-র ১২২টি উদ্যোগ ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৩২টি প্রকল্পে কিছুটা হলেও টাকা ঢেলেছে চীন। 

সাত বছর পার হয়ে গেলেও কোনও প্রকল্পের কাজই শেষ হয়নি। এই চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সমুদ্রবন্দর, সড়ক, রেলপথ, পাইপলাইন, বিমানবন্দর-সহ ডজন খানেক কারখানা। সবকিছুরই ভবিষ্যত এখন অন্ধকারে। 

চীনের অর্থনীতি ডুবছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দুনিয়াবাসীকে দেখিয়েছিল কমিউনিস্ট দেশটিষ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অতোটা ভালো ছিলনা। 

মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েই চলেছে। আমেরিকাকে টক্কর দিতে গিয়ে উল্টে বিপাকে পড়েছে চীন। করোনা ভাইরাস তাদের আরও বিপাকে ফেলেছে। 

জিডিপি ৩১৭ দেখাতে গিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশটি। এক কথায় চীনের আর্থিক পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। 

তাই সিপিইসি-র পাশাপাশি চীন বহু প্রকল্পেই টাকা ঢালা বন্ধ করে দিয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেই চীনের বিনিয়োগ এখন বন্ধ। ১৩৮ দেশকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার স্বপ্ন থেকে পিছিয়ে আসছে চীন সরকার। বিভিন্ন প্রকল্পের ডানা ছাঁটা হচ্ছে। সেইসঙ্গে বাতিলও হচ্ছে ঘোষিত বহু প্রকল্প। 

মালেশিয়ায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাইপলাইন প্রকল্প ইতিমধ্যেই বাতিল করেছে চীন। ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক প্রকল্পেও বিনিয়োগের বহর অনেক কমানো হয়েছে। 

২ বিলিয়ন ডলারের কেনিয়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কর্মসূচি থেকেও পিছু হঠেছে তারা। প্রকল্পটি নিয়ে অবশ্য আগেই আপত্তি জানিয়েছিল আফ্রিকার আদালত। এখন চীন নিজেই বাতিল করেছে সেই বিদ্যুত প্রকল্প। 

মিয়ানমারে ৭.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে চীন বন্দর বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। কিন্তু এখন খরচ কমিয়ে সেটাই করা হচ্ছে মাত্র ১.৩ বিলিয়ন ডলারে। সিয়েরা লিওনে বিমানবন্দর বানানোর কর্মসূচিও বাতিল করা হয়েছে। তানজানিয়ার ১০ বিলিয়নের বাগামায়ো প্রকল্পও বন্ধ করে দিয়েছে চীন। বাতিল করেছে। 

বাংলাদেশের সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকেও পিছু হঠেছে তারা। 

অর্থনীতিবিদরা নিশ্চিত, বড়ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে  শি জিনপিং সরকার। বিশেষ করে জো বাইডেনের নেতৃত্বে মার্কিন প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে আরও কড়া পদক্ষেপ নেওযার ইঙ্গিত দেওয়ায় মহা সমস্যায় পড়েছে দেশটি। বাইডেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, চীনকে সবক শেখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবেনা। 

ইতিমধ্যেই চীনের বাজার সঙ্কুচিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ভারত তো চীনা পণ্য আমদানি অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে রীতিমতো বানিজ্য-যুদ্ধ শুরু হয়েছে চীনের। হংকং নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খারাপ। ফলে দ্রুত আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির কোনও রাস্তা চীনের সামনে নেই। ফলে চীনের আর্থিক ধুকধুকানি চলবেই, মত বিশেষজ্ঞদের।

আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারীত্ব বা আরসিইপি গড়ে উঠেছে। ১৫টি দেশ এই আঞ্চলিক সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত। ২০২০ সালে আরসিইপি প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০২২ সাল থেকেই তারা পথচলা শুরু করবে। 

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমেও কোনও উল্লেখযোগ্য সুরাহা মিলবেনা চীনা অর্থনীতির। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে ভিয়েতনাম ও মালেশিয়ার বানিজ্যিক মনোভাব। সবদিক থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চীন। নতুন বছর তাদের কাছে আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে। 

আর্থিক দূরাবস্থা থেকে বার হওয়ার পথ সহজে মিলছে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত বিশেজ্ঞরা। 

অবশ্য, আদৌ চীন তাদের বিপথে চালিত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে কিনা তা নিয়েও গভীর সংশয়ে বিশেজ্ঞরা। ফলে শুধু বিআরআই-ই নয়, চীনের বহ কর্মসূচিও এখন বন্ধ হওয়ার পথে।