করোনা ভাইরাসের টিকার প্রথম প্রয়োগ হবে আগামী বুধবার (২৭ জানুয়ারি)। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন নার্সকে টিকা প্রদানের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে। পরদিন ঢাকার আরও কয়েকটি হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জন টিকা পাবেন। তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখার পর ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে।ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ টিকা গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় পৌঁছায়। 

আগামীকাল সোমবার বা মঙ্গলবার সরকারের কেনা ৩ কোটি ডোজের মধ্যে প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান গতকাল রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিসেস অ্যান্ড ইউরোলজি পরিদর্শনকালে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ জানুয়ারি টিকা দেওয়ার কার্যক্রম ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রথম টিকা দেওয়া হবে একজন নার্সকে। 

এ ছাড়া আরও ২৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সময় কাজ করা সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা থাকবেন। এর পর ২৮ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। 

তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখার পর ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে।প্রস্তুতিতে ঘাটতির অভিযোগ টিকা গ্রহণকারীদের নাম নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নামে যে অ্যাপস তৈরি কাজ চলছে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো শেষ হয়নি টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদের প্রশিক্ষণ। জেলা পর্যায়ে দুজন চিকিৎসক, সিভিল সার্জনসহ কিছু পদে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলেও প্রশিক্ষণ হয়নি উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক, টিকাদানকারী নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকদের। 

টিকাদান সেন্টার নির্ধারণ, টিকা প্রয়োগকারীর তালিকায় স্বাস্থ্য সহকারী ও সিএইচপিদের অন্তর্ভুক্ত না করাসহ নানা ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।করোনার টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে প্রশিক্ষণ। গত ৪ জানুয়ারি এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে এবং চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রশিক্ষণকালে টিকা গ্রহণকারীর তালিকা তৈরি, টিকা সংরক্ষণ, পাশর্^প্রতিক্রিয়া হলে চিকিৎসা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনসহ বিভিন্ন বিষয় শেখানো হচ্ছে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, সরকারের টিকা বিতরণ পরিকল্পনায় দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা হাসপাতালগুলোকে সেন্টার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। 

দেশে ৬৪টি জেলা, ৪৯২টি উপজেলা এবং ১০০টির বেশি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। একটি উপজেলায় মানুষ আছে ৫ লাখ। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে বাদ দিলে প্রায় ৩ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে। একটি সেন্টারে যদি ১০০-১৫০ জনকে টিকা দেয় তা হলে ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে অনেক সময় লাগবে। টিকাদান সেন্টার স্বল্পতা টিকা বিতরণ পরিকল্পনার একটি বড় ঘাটতি। টিকাদান কেন্দ্র নিয়ে যেতে হবে মানুষের ঘরের কোনায়। 

আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে টিকাদানের জন্য সবচেয়ে ভালো। পরিকল্পনায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যুক্ত করা হলে টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রকেও সেন্টার বানাতে হবে। টিকা প্রয়োগের পর কারও পাশর্^প্রতিক্রিয়া হলে তাদের চিকিৎসা প্রদানে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন মেডিক্যাল অফিসারের নেতৃত্বে একটি টিম রাখতে হবে।তিনি আরও বলেন, এতদিন পর্যন্ত টিকা দিয়ে আসছে আমাদের স্বাস্থ্য সহকারীরা। তারা অভিজ্ঞ। টিকাদান শুধু ইনজেকশন পুশ করাই নয়, টিকা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা, লোকজনকে টিকা সম্পর্কে বলা, এর সমস্যা সম্পর্কে বলা, সময় সম্পর্কে বলতে হবে। 

সেই স্বাস্থ্য সহকারীদের মানুষ ৩০-৪০ বছর ধরে চেনে। সেই মানুষগুলো যুক্ত না হয় তা হলে মানুষ কি টিকা নিতে যাবে? তাদের টিকা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করা একটি ত্রুটি। এ কাজের সঙ্গে স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচপি ও এনজিওকর্মীদের যুক্ত করতে হবে। টিকাদান কেন্দ্র বাড়ির কাছাকাছি গেলে আর স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচপি ও এনজিওকর্মীরা ঘরে ঘরে যোগাযোগ করলে মানুষ টিকা নিতে যাবে। এ পদ্ধতিতে আগাতে হবে। 

টিকা কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। তালিকা তৈরি করে স্থানীয় ভাষায় আলাপ-আলোচনা করতে হবে।করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনা ভাইরাসের টিকা বিতরণ পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। 

এ ভাইরাসটি নতুন। আর আগে বয়স্কদের টিকা দেওয়া হয়নি। সে জন্য অনেকখানি দুর্বলতা আছে। এর একটি হচ্ছে পাশর্^প্রতিক্রিয়া। কী ধরনের পাশর্^প্রতিক্রিয়া হবে, আর এর চিকিৎসা কী হবে তা আমরা জানি না। শুধু এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। 

এ ছাড়া আরও অনেক দুর্বলতা আছে। যেমন আমাদের যদি টিকা উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণ করতে হয় আমরা ঠিকমতো তা করতে পারব কিনা। আরেকটি হচ্ছে, টিকার বিষয় নিয়ে মানুষের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ শুরুই হয়নি, এটি বড় ধরনের সমস্যা হবে। স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ করতে হবে, যেমন সিলেটের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে সিলেটি ভাষায়, চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষায় আলাপ-আলোচনা করতে হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, করোনার টিকা প্রদানে দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা-উপজেলা হাসপাতালে টিকাদান সেন্টার থাকবে। এ ছাড়া রাজধানীতে ৩০০টি সেন্টার থাকবে। 

দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যায়ে ৬টি, জেলা পর্যায়ে ৪টি এবং উপজেলা পর্যায়ে দুটি করে টিকাদানকারী দল থাকবে। প্রতিটি দল দিনে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে টিকা দিতে পারবে। টিকা প্রদানের পর কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে টিকা গ্রহণকারীকে ৩০ মিনিট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাখা হবে। 

প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের অগ্রাধিকার টিকা দেওয়া হবে। দেশের সব জেলা, উপজেলা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন আনুমানিক দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।